ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং কি?

ডেটা ড্রিভেন বা তথ্য-চালিত মার্কেটিং হলো ডেটা বা তথ্য নির্ভর একটি মার্কেটিং কৌশল যেখানে গ্রাহকদের সম্পর্কে আরও ভালো দৃষ্টিভঙ্গি (Insights) বা ধারনা অর্জনের জন্য গ্রাহকের মিথস্ক্রিয়াগুলো এবং তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে পাওয়া গ্রাহকের অনুপ্রেরণা, পছন্দ, আচরণ ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে প্রচুর পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

এ ধরণের মার্কেটিং প্রচলিত  সাধারণ মার্কেটিং সিস্টেম থেকে পুরোপুরি আলাদা। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের সামনে সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায়, সঠিক অফার নিয়ে হাজির হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। যেখানে সাধারণ মার্কেটিং পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত ডেটা বা তথ্য-উপাত্ত ও যথাযথ বাজার বিশ্লেষণ না থাকার কারণে শুরুতেই অনেকগুলো ভুল-ভ্রান্তির মুখোমুখি হতে হয়।

ডেটা ড্রিভেন এর মত কৌশলগত ও পরীক্ষিত পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব সহজেই এ ধরণের সমস্যা থেকে উত্তরণ পাওয়া যায়। তাছাড়াও এ পদ্ধতি ব্যবসায়ীদের সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ও সময়ের সাথে সাথে ব্যবসায়ীক কৌশল উন্নয়নে সহায়তা করে।

ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং গুরুত্বপূর্ণ কেন?

এখানে কোনো সন্দেহ নেই যে মানুষের পছন্দ-অপছন্দের উপর তাদের চিন্তা-ভাবনা ও আচরন অনেকটাই নির্ভর করে।

ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিংয়ে এ সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেই একজনের ক্রেতা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে সত্যিকারের ক্রেতায় পরিণত করা হয়।

উদাহরণসরুপঃ আমরা যদি একটি এনার্জি ড্রিংস কোম্পানি কথা বিবেচনা করি, যারা মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পানীয় সরবরাহের কাজ করে থাকে। তারা তাদের বিজ্ঞাপণ প্রচারের পরও খুব কম (মাত্র ৫%) মানুষের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছে। কিন্তু ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং কৌশল ব্যবহার করে খুব সহজেই এ ক্রেতার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।

ডেটা ড্রিভেন কৌশল অনুসরণ করে বিশাল তথ্য ভান্ডার ব্যবহার করে প্রথমেই বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংস গ্রহনকারী ব্যক্তিদের ডেটা বিশ্লেষণ করা হয়। এখন আপনার কাছে থাকা এসব তথ্য ব্যবহার করে আপনি সেইসব লোকদের বিজ্ঞাপণ দেখাতে পারবেন, যারা নিয়মত বা খুব বেশি এনার্জি ড্রিংস ব্যবহার করে।

এর ফলে আপনার বিজ্ঞাপণ হাজার হাজার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে না দিয়ে শুধুমাত্র পানীয় গ্রহনকারীদের কাছেই পৌঁছাবে। যা অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার পণ্যের প্রত্যাশিত ক্রেতা পেতে সাহায্য করেবে।

ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং মূলত কোম্পানিগুলোকে ক্রেতাদের পণ্য কেনাকাটা বা ক্র‌য় করার অভ্যাস সম্পর্কে বিশেষ তথ্য দেয়। গ্রাহকদের সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার জন্য ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং বয়স, আয়ের পরিমাণ, বৈবাহিক অবস্থা, সন্তান, জন্মদিন ইত্যাদির মত ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে থাকে।

কিভাবে ডেটা বা তথ্য ব্যবহার করে আপনার লক্ষ্যে পৌছাবেন?

সাধারণত সব ব্যবসায়ীর লক্ষ্য থাকে ক্রেতা তৈরি করা এবং তাদের কাছে পণ্য বিক্রি বা সেবা প্রদানের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা।

যাই হোক না কেন, প্রত্যেক মার্কেটিং ক্যাম্পেইন বা প্রচারের জন্য কোনো না কোন লক্ষ্য অবশ্যই থাকে। সেটা হতে পারে মুনাফা অর্জন, পন্য বিক্রি,নতুন ক্রেতা যুক্ত করার নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমাত্রা কিংবা আরও অন্যকিছু।

ব্যবসায়ীরা ডেটা ড্রাইভেন মার্কেটিং Insights (দৃষ্টিকোণ) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তাদের লক্ষ্যে পৌছা্নোর জন্য ব্যবহার করে থাকে। B2C (Bussiness to Consumer) ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে বিশাল পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। যেমন, CES (Customer effort scores), NPS (Net promoter scores) ইত্যাদি।

ডেটা ড্রাইভেন কৌশল ব্যবহার করে বিশাল এই তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে আপনার ব্যবসায়ের জন্য উপযুক্ত একটি অংশকেখুঁজে বের করা সম্ভব হয় যাদের পছন্দ, আচরণ-অভ্যাস একই রকম।

এখন আপনার ব্যবসায়ের জন্য উপযুক্ত এ অংশকে টার্গেট করে আপনি সহজেই আপনার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা (সঠিক ক্রেতাকে টার্গেট, বিজ্ঞাপন, ক্যাম্পেইন) ইত্যাদি তৈরি করতে পারেন। যা আপনাকে ব্যবসায়িক লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।

কিভাবে ডেটা বা তথ্য ব্যবহার করা হয়?

ব্যবসায়ীরা ডেটা ড্রাইভেন মার্কেটিং ব্যবহার করে ডেটা ব্যবহার করার অনেকগুলো উপায় খুঁজে বের করেছেন। উদাহরণস্বরুপঃ

  • আপনি যদি একই সাথে আপনার ব্যবসায়িক প্রচারনা অনেকগুলো চ্যানেলে প্রচার করে থাকেন, তাহলে কোন চ্যানেলটি কোন পর্যায়েসবচেয়ে ভালো পারফর্ম করছে তা ডেটা ব্যবহার করে নির্ধারণ করা যেতে পারে। এখান থেকে আপনি সে সময় ও চ্যানলটিকে আপনার বিজ্ঞাপণ দেয়ার জন্য বেছে নিতে পারেন।

 

  • ওয়েবসাইট চ্যানেল্গুলো প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে কোম্পানিগুলোকে তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য জায়গা বিক্রি করে থাকে। কোম্পানিগুলো এখান থেকে তাদের টার্গেট অডিয়েন্সকে বিজ্ঞাপণ দেখাতে পারে। যেমন, শ্যাম্পু কোম্পানিগুলো আদ্র আবহাওয়ার মানুষদের সরাসরি টার্গেট করে খুব সহজেই তাদের বিজ্ঞাপণ দিতে পারে।

 

  • Netflix এবং এর স্ট্রিমিং ভিডিও প্রতি্যোগী যেমন, Spotify এর ব্যবহারকারীদের পূর্বের সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে, পূর্বের ডেটা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমেসিনেমা ও গান সাজেস্ট করে থাকে।

ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং কৌশল বাস্তবায়ন

১. প্রথমেই আপনি ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং থেকে যে লক্ষ্য অর্জন করতে চান তা নির্ধারণ করুন। এক্ষেত্রে আপনার সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অনেকেই S.M.A.R.T পদ্ধতিটি ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকে।

  •  Specific (নির্দিষ্ট)- এলোমেলোভাবে আপনার আয় বাড়ানোর কথা না ভাবে ১০% বা ১৫% আয় বৃদ্ধি করবেন এরকম একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রাখুন।
  •  Measurable (পরিমাপযোগ্য)- এগুলোকে অবশ্যই হ্রাস করার মত হতে হবে।
  • Achivable (অর্জনযোগ্য)- লক্ষ্যগুলোকে অবশ্যই অর্জনযোগ্য হতে হবে। তা না-হলে আপনার কোনো উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
  • Relevant (প্রাসঙ্গিক)- লক্ষ্যগুলোকে প্রাসঙ্গিক হতে হবে এবং আপনার কোম্পানির জন্য লাভজনক হতে পারে।
  • Timely (সময়োপযোগী)- প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আপনার যুক্তিসঙ্গত সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে।

 

২. আপনি যে লক্ষ্য অর্জন করতে চান তা ঠিক করে নিন। এটা হতে পারে নতুন ক্রেতা যুক্ত করা, মুনাফা, আয়, গ্রাহক অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

৩. এমন একটি টিম তৈরি করুন যাদের আপনার ডেটা বা তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করার মত প্রয়োজনীয় দক্ষতা আছে। এক্ষেত্রে আপনার দলে বিপনণ, আইটি, মার্কেটিং, গ্রাহক সেবা ইত্যাদির মত বিভিন্ন বিভাগ থেকে কর্মী সংগ্রহ করতে হবে।

৪. আপনার ক্রেতাদের একটি তালিকা তৈরি করুন।

৫. আপনার জন্য কোন ধরনের ডেটা/তথ্য প্রয়োজন তা নির্ধারণ করুন। আপনার ক্যাম্পেইনের উপর নির্ভর করে আপনি তাদের ব্রাউজিং ডেটা, সোশ্যাল মিডিয়া মিথস্ক্রিয়া, সি আর এম দ্বারা প্রাপ্ত ডেটা ও জরিপের ফলাফল ইত্যাদি দেখতে পারেন।

৬. আপনার কর্মপ্রবাহ স্বয়ংক্রিয় করুন। আপনার সংগ্রিহিত তথ্যগুলো নিয়ে কাজ করে এমন স্বয়ংক্রিয় টুল বাছাই করুন।

৭. আপনার ডেটা সংগ্রহ করুন, তা তৃতীয় পক্ষ, দালাল কিংবা অন্য যে কোন মাধ্যম থেকেই আসুক না কেন।

৮. এরপর আপনার ডেটাগুলোকে বিশ্লেষণ করার জন্য আপনার স্বয়ংক্রিয় টুল ব্যবহার করুন।

৯. এখন এ বিশ্লেষণ থেকে আপনি কোন মাধ্যমগুলোতে আপনার প্রচার চালাবেন তা নির্ধারণ করে নিন। আপনি চাইলে ই-মেইল মার্কেটিং, কনটেন্ট মার্কেটিং, পিপিসি বিজ্ঞাপণ ছাড়াও আপনার উপযুক্ত যে কোনো মাধ্যম বাছাই করতে পারেন।

১০. সবশেষে, এখন আপনার প্রচার শুরু করুন। আপনার ফলাফল পর্যালোচনা করুন, বিনিয়োগের রিটার্ন হিসাব করুন এবং আপনি যা শিখলেন তা পরবর্তী প্রচারে কাজে লাগান।

ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং এর গতিধারা।

যে সকল ব্যবসায়ীরা ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং ব্যবহার করে তাদের ব্যবসার গতি নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছেন তারা এখান থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেন্ড (গতিধারা) খুঁজে পাবেন। এগুলোর মধ্যে প্রধানতম কারণ হলো বিভিন্ন শিল্পে ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং এর ক্রমবর্ধ্মান প্রভাব। ডেটা ড্রিভেনে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার ভবিষৎদ্বানীমূলক বিশ্লেষণ ও ক্রেতাদের আরও দক্ষতার সাথে যোগযোগ করতে সক্ষম করে তোলে।

ভবিষৎদ্বানীমূলক বিশ্লেষণগুলো ব্যবসায়ীদের তিনটি উপায়ে সহযোগীতা করে থাকে।

১.সন্দেহভাজন অ্যাকাউন্টগুলোর উপর ব্যবস্থা গ্রহনের ক্ষেত্রে।

২.বর্তমান গ্রাহকদের সম্ভাবনাগুলোকে শনাক্ত করে নতুন গ্রাহক নিয়ে আসার সক্ষমতা অর্জনে।

৩.গ্রাহকদের কাছ থেকে আরও কার্যকরী তথ্য সরবরাহ করতে।

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কেটিং টিমকে একটি পৃথককারী দেয়াল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। একসাথে দল হিসেবে কাজ করলে অনেক বিষয় ভালোভাবে বুঝতে ও শিখতে পারা যায়। যেমন, একটি ক্লিক থেকে শুরু করে, ক্রেতাদের চ্যাট শুরু করা, পিডিএফ ডাউনলোড করা। যা ক্রেতাদের সাথে একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করে।

পরিসেশে বলা যায় ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং এর একটি সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষৎ সামনের দিনগুলোতে অপেক্ষা করছে। সময়ের সাথে সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভবিষতদ্বানীপূর্ণ বিপনণ ব্যবস্থায় ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং সফল্ভাবে বিজ্ঞাপণ প্রচারের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাই আর বলার অপেক্ষা থাকে না, আগামীটা যে হবে ডেটা ড্রিভেন মার্কেটিং এর রাজত্বের।